লেখক: মোহাম্মদ আলতাফ হোসাইন, সাবেক সভাপতি, সিপিবি, দিনাজপুর;
সাবেক সভাপতিমন্ডলির সদস্য, সিপিবি, কেন্দ্রীয় কমিটি;
কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, সিপিবি
বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের সংগ্রামী নেতা, ঐতিহাসিক তে-ভাগা আন্দোলনের বীরযোদ্ধা, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনসহ স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নেতা, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনের লড়াকু সৈনিক কমরেড গুরুদাস তালুকদার দূরারোগ্য ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৮০ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
আমি তখন ছাত্র। প্রথম দর্শনেই কিছুটা বিস্মিত হয়েছিলাম এই জেনে যে, তিনি একজন কমিউনিস্ট। কমিউনিস্ট কী? কী করলে কমিউনিস্ট হওয়া যায়, তখনও এসব ব্যাপারে আমার তেমন কোন সুষ্পষ্ট ধারণা ছিলনা। তাই একদিন সরাসরি তাঁর কাছে গিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম দাদা, আপনি নাকি কমিউনিস্ট? গুরুদা’ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আমি তার এই তীক্ষ্ণ চাহনি দেখে রীতিমত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভাবলাম প্রশ্নটা করা ঠিক হলো কিনা। তেমন কোন আলাপ নেই, পরিচয় নেই, এ ধরণের প্রশ্ন করা কোন ধৃষ্টতা কিনা। কিন্তু ভয় আমার দ্রুতই কেটে গেল। যখন তিনি অত্যন্ত সাবলীল ভঙ্গিতে মুখ খুলে বললেন, “কই আর কমিউনিস্ট হতে পারলাম। তবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।” তাৎক্ষণিকভাবে তার সেই কথার অর্থ বুঝে উঠতে পারি নাই। তবে তারও অনেক দিন পর যখন আমি নিজেই কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে পরিচিত হলাম, কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করলাম, তখন বুঝতে পারলাম সত্যি কমিউনিস্ট হওয়া কত কঠিন কাজ।
কমিউনিস্ট আদর্শে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সেই আদর্শ বাস্তবায়নে সক্রিয় কর্মকান্ডে জড়িত থাকা যত না কঠিন, তার চেয়েও কঠিন কাজটি হলো নিজেকে কমিউনিস্ট হিসাবে গড়ে তোলা। কমরেড গুরুদাস তালুকদার তাঁর সারাটি জীবন উৎসর্গ করেছিলেন এই কঠিন কাজটি করার জন্য এক নিরন্তর লড়াই এ। তাঁর গোটা জীবনটাই ছিল একটা ত্যাগের ইতিহাস। তাঁর ত্যাগের কথা আলোচনা করলে নিজেকে বড় ম্রিয়মান মনে হয়।
তিনি রংপুর জেলার পীরগাছা উপজেলার মন্থনা পরগনার অধিনে এক সম্ভ্রান্ত তালুকদার পরিবারের একমাত্র পুত্র সন্তান ছিলেন। পিতা তাঁর সন্তানকে ডাক্তার বানানোর উদ্দেশ্যে পড়াশোনা করার জন্য কলকাতায় পাঠান কিন্তু তিনি সেখানে গিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন। একমাত্র সন্তান রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়–ক তাঁর পিতা তা চাননি। তাই তাঁর পিতা তাঁকে বাড়িতে ডেকে এনে ‘‘হয় বিত্ত-বৈভব, নয়তো রাজনীতি” এ দু’টির যে কোন একটি গ্রহণের প্রস্তাব রাখেন। তিনি কোনরকম দ্বিধা-দ্বন্দ্ব না করে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রাজনীতিকে গ্রহণ করেন এবং পিতার বিত্ত-বৈভব পরিত্যাগ করে বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় চলে যান। কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে তিনি তে-ভাগা আন্দোলনের দায়িত্ব নিয়ে দিনাজপুরে চলে আসেন এবং জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত দিনাজপুরেই স্থায়ী হন।
তিনি ছিলেন দীর্ঘদেহী এবং অত্যন্ত ভরাট গলার মানুষ। সভা সমাবেশে বক্তব্য দেয়ার সময় তাঁর মাইক না হলেও চলতো। খালি গলায় তিনি অত্যন্ত সাবলীলভাবে বক্তব্য দিয়ে যেতে পারতেন। কথিত আছে যে, একবার দিনাজপুর জেলার বোচাগঞ্জ উপজেলার এক জনসভায় তাঁর এই ভরাট গলার বক্তৃতা শুনে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাস করা ঐ এলাকার তরুণ আইনজীবী হাজী মোহাম্মদ দানেশ ভীষণভাবে উদ্বুদ্ধ হন এবং পরবর্তীতে তিনিও কৃষক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। পরবর্তীতে তিনি একজন খ্যাতিমান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন।
কমরেড গুরুদাস তালুকদারের আচার-আচরণ ছিল অত্যন্ত সাধারণ। একটা সাদা পাঞ্জাবি, দু’খানা সাদা ধুতি, একটা সাদা গেঞ্জি, শীত নিবারণের জন্য একটা চাদর- এই ছিল তাঁর সম্বল। তামাকপাতা কচলিয়ে চুন মিশিয়ে খৈনি খাওয়া তার ছিল প্রিয় অভ্যাস, সেই সাথে ভরা গ্লাস দুধ-চা। রান্না-বান্নার কাজটি তিনি নিজ হাতেই করতে পছন্দ করতেন, এ ব্যাপারে তিনি কারও নাক গলানো পছন্দ করতেন না। এক কথায় তিনি ছিলেন একজন পাঁকা রাঁধুনি। আর এজন্যই কৃষক সমিতির বড় বড় সম্মেলনগুলোতে খাদ্য বিভাগের বিশাল দায়িত্বটা তাঁর উপরেই ন্যস্ত করা হতো। এ প্রসঙ্গে একটি চমকপ্রদ ঘটনা আছে। একবার জেল জীবনে তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে পার্টির কমরেডরা মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিয়ে তাঁকে জেলখানার রান্নাঘরে ঢুকতে নিষেধ করেন। পার্টির সিদ্ধান্ত মেনে নিলেও মনে মনে তিনি খুব অসন্তুষ্ট হন এবং পার্টির সিদ্ধান্ত মেনে নিলেও রান্না ঘরের জানালায় উঁকি মেরে রান্নার কাজে নানা পরামর্শ দিতেন। এরকম অনেক মজার কাহিনী তাঁর এই অকৃতদার সংগ্রামী জীবনকে ঘিরে রয়েছে।
তাঁর মৃত্যু হয়েছিল পরিণত বয়সেই দিনাজপুরের গুড়গোলা নিবাসী মেঘাদা’র বাসায়। যখন তিনি মৃত্যুশয্যায় শায়িত এবং ছাত্র ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরা যখন পালা করে তাঁর দেখাশুনার দায়িত্ব পালন করছে- ঠিক সেই মুহুর্তে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে পার্টির চতুর্থ কংগ্রেস। অসুস্থতার কারণে কংগ্রেসে শরিক হতে না পারার বেদনা যেন তাঁর শারীরিক অসুস্থতাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। তিনি দূরারোগ্য ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। মৃত্যুশয্যায় শায়িত হয়েও আদর্শের প্রতি কতটুকু বিশ্বস্ত থাকলে একজন মানুষ তাঁর জীবনকে অতি তুচ্ছজ্ঞান করে শুধু তাঁর স্বপ্নের কথাকে এভাবে অকপটে প্রকাশ করতে পারেন।
তাঁর রাজনৈতিক জীবন ছিল এক বর্ণাঢ্য কিংবদন্তী। সূচনালগ্নে কেবল বৃটিশ বিরোধী লড়াই সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়লেও ধীরে ধীরে তিনি মানুষের জন্য শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সামিল হন এবং মার্কসবাদ-লেনিনবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষের জন্য মুক্ত সমাজ তথা সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে শামিল হয়ে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন এবং তিনি এদেশের শ্রমিক, কৃষক ও মেহনতি মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে শামিল হয়ে জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত নিজেকে নিয়োজিত রাখেন।
পার্টির নানা কর্মসূচির ফাঁকে তিনি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের যুক্ত থাকতেন। তিনি দিনাজপুর নাট্য সমিতির সদস্য ছিলেন। তিনি ভাল অভিনয় করতেন। বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তাঁর শিল্পী সত্ত্বাও তুলে ধরেছেন সাংস্কৃতিক অঙ্গনে।
তাঁর মৃত্যু মানব মুক্তির লড়াইয়ে এক অপূরণীয় ক্ষতি। তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই অসাম্প্রদায়িক চেতনায় গণমানুষের অধিকার আদায়ের এক সংগ্রামী সৈনিক হিসেবে।